নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল, তার প্রভাবে সেখানে প্রচুর বস্তু উৎপাদিত হতে থাকে। ফলে বস্তু শিল্পের জন্য নীলের চাহিদাও বাড়তে থাকে, অধিক মুনাফার আশায় কোম্পানির কর্মচারীরা নীলচাষিদের উপর নির্মম অত্যাচার ও সীমাহীন শােষণ শুরু করে। নীলচাষকে কেন্দ্র করে এই শোষন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৮৯ সালে নীল বিদ্রোহ হয়েছিলা।

নীল বিদ্রোহের কারণ

দাদন প্রথা: নীলকর সাহেবরা নীল চাষ করার জন্য চাষীকে অগ্রিম কিছু টাকা দিত এই টাকা ‘দাদন’ নামে পরিচিত। এই প্রথায় নীলকররা চাষিদের দাদন নিতে বাধ্য করতো এবং একবার দাদন নিলে তারা নীলকরদের দাসে পরিণত হত। প্রথমদিকে লোভে চাষিরা দাদন প্রথায় নীল চাষ করতে আগ্রহী হলেও পরে তারা এর কুফল সম্পর্কে বুঝতে পারে।

নীলকরদের অত্যাচার: চাষীরা নীল চাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকর সাহেবরা চাষীদের উপর নির্মম অত্যাচার করত। তাদের উপর দৈহিক অত্যাচার চালাত এবং তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত, গবাদি পশু নিয়ে চলে যেত এমনকি বাড়ির মহিলাদের সম্মানহানি বাড়তেও তারা পিছপা হতো না। দিন দিন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছিল। যে কারনে চাষীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করেছিল।

পঞ্চম আইন: ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক প্রবর্তিত কুখ্যাত পঞ্চম আইন ঘোষণা করা হয়। এই আইনে বলা হয়েছিল দাদন গ্রহণকারী কোন চাষী নীলচাষ করতে না চাইলে তার নামে ফৌজদারি মামলা করা যেতে পারে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই কৃষককের দীর্ঘকাল জেল হবে।

অন্যায় অবিচার: নীল বিদ্রোহের পূর্বে নীলকররা ব্যাপক অব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল। অত্যাচারিত নীল চাষীরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না উল্টে তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা হতো। আইন ছিল শুধুমাত্র নীলকরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষপাতী। এর ফলে চাষিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।

প্রতারণা ও কারচুপি: নীলকররা চাষীদের সাথে বিভিন্ন ভাবে প্রতারণা করত। নীল কেনার সময় নীলকররা নীলচাষিদের নীলের ওজন কম দেখাত, অত্যন্ত কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করা হত। জমির মাপে কারচুপি করত প্রায় আড়াই বিঘা জমি কে এক বিঘা বলত এবং জোর করে বিভিন্ন ভাবে অর্থ আদায়ও করতো।

পত্র পত্রিকার প্রভাব: নীলচাষীদের উপর নীলকরদের নির্মম অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীল চাষীদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা নিয়মিত প্রকাশ করা হত এছাড়া দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নীলদর্পণ নাটকের মাধ্যমে নীলকরদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার তুলে ধরা হয়।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল

নীল কমিশন গঠন: নীল বিদ্রোহের ফলে সরকার বাধ্য হয়ে 1860 খ্রিষ্টাব্দের 31 ডিসেম্বরে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন দ্বারা নীল চাষকে নীলচাষীদের ইচ্ছাধীন করা হয় এর ফলে নীলকররা নীলচাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।

কৃষকদের সাফল্য: নীল বিদ্রোহের ফলে কৃষকরা নীল চাষ থেকে মুক্তি পায়। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সাফল্য বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধতা: নীল বিদ্রোহের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকই ঐক্যবদ্ধ ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং এই বিদ্রোহের ফলেই বাংলার কৃষক, জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে মিলবন্ধন তৈরি হয়েছিল।

মহাজনদের কর্তৃত্ব প্রতি: নীল বিদ্রোহের ফলে নীলকরদের পতন এবং মহাজন শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। Blair Kling তাঁর Blue Mutiny গ্রন্থে বলেন যে, " নীলকর সাহেবদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গের কর্তৃত্ব সুদখাের মহাজনদের হাতে চলে যায়। "

কথোপকথনে যোগ দিন